বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে একটি ছোট্ট কৃষি প্রধান দেশ যার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে প্রায় ১০০০ জন মানুষ যা কিনা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বহুগুণে বেশি। তাই বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠির সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য এ দেশের প্রায় ২৩.৫ মিলিয়ন গরু, ১ মিলিয়ন মহিষ, ৩৪ মিলিয়ন ছাগল ও ৩ মিলিয়ন ভেড়া প্রাণিজ আমিষ যেমন- দুধ, মাংসের চাহিদা পূরণ, কৃষি কাজ, হাল চাষ, চামড়া রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, গ্রামীণ পরিবহনে গাড়ী টানা, জ্বালানী ও মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য গোবর, ধর্মীয় সন্তুষ্টিতে পশু কোরবানী, কর্ম-সংস্থানসহ দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থ উর্পাজন, এবং পরিবেশ রক্ষাসহ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। গবাদিপশু আর অবহেলিত সম্পদ নয় বরং এটি খামারীর নিকট একটি অতি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গবাদিপশুর গুরুত্ব অনুধাবন করেই এদেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৭৫ ভাগের বেশি লোক কোনো না কোনো পশু-পাখি পালন করে থাকেন।
লাম্পি স্কিন’ রোগে মৃত্যুহার কম হলেও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দুগ্ধ ও চামড়া শিল্পে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পশুর চামড়া অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যায়। আবার গাভী আক্রান্ত হলে দুধ উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসে। দেশের দুধ উৎপাদনকারী খামারগুলোয় এ রোগের প্রভাব পড়ছে। দুধ উৎপাদন কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা।
এদিকে দেশে গরুর ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ ছড়িয়ে পড়লেও এতে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, খুব সাধারণ চিকিৎসায় গবাদি পশুর এই রোগ সারানো সম্ভব। সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। লাম্পি স্কিন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভ্যাকসিন / টিকা কী?
ভ্যাকসিন বা টিকা একটি জৈবিক প্রোডাক্ট। নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত প্রাণীর দেহ হতে উক্ত জীবাণু সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। পরে ওই জীবাণুকে নিস্তেজ বা অর্ধমৃত বা মৃত অবস্থায় এনে এক ধরনের জীবাণুজাত ওষুধ তৈরি করা হয় যা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দেহে প্রবেশ করালে উক্ত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জাতীয় রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, যাকে ভ্যাকসিন বা টিকা বলে।
কোল্ড চেইন (Cold chain)
কোন্ড চেইন বলতে এমন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যেখানে ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার পর থেকে তার গুণাবলী অক্ষুণœ রাখার জন্য ব্যবহারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ধরে রাখা এবং এই কার্যকারিতা ধরে রাখতে সব সময়ই যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়। ভ্যাকসিন তাপের প্রতি সংবেদনশীল এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকের নির্দেশাবলী কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে এবং নির্দিষ্ট তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করতে হবে। অপর কথায় বলা যায় কোনো ধরনের বিরতি ছাড়াই সব সময় অনুকূল পরিবেশে ভ্যাকসিন পরিবহন করতে হয়। কোল্ড চেইন বজায় রাখার জন্য যে সব উপাদানের প্রয়োজন হয় তা হলো- কোল্ড রুম, ফ্রিজার রুম, রিফ্রিজারেটর, ডীপ ফ্রিজার, রিফ্রিজারেটেড ট্রান্সপোর্ট, কোল্ড বক্স, ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার, আইসপ্যাক, থার্মোমিটার, ইত্যাদি।
তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে লাম্পি ভ্যাক্স নামে একটি টিকা উৎপন্ন হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় সেটা দিয়ে উপকার পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর বড় গুরুর থেকে বাছুর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। রংপুর জেলায় এ বছর এখন অবধি ৩০টি গরু মারা গেছে। আর পুরো বিভাগে সেটা ২০০/২৫০ টি হতে পারে। রংপুরসহ আশেপাশের বিভাগগুলোর পশুও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়াতে লাম্পি স্কিন রোগ দেখা দেয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। মশা-মাছি বাহিত রোগটি মূলত মশার মধ্যমেই বেশি ছড়ায়। আক্রান্ত গরু সুস্থ হতে দীর্ঘদিন সময় লাগে। দিন দিন গরু-বাছুর দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। একটি খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দিতে খুরা রোগের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রোগ লাম্পি স্কিন।
বাংলাদেশে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রথম দেখা দেয় ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে। এরপরই মাঠে নামে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তদন্ত টিম। তখন দেশের ১২ জেলায় ৪৮ হাজার গরুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এ বছর আবার রোগটি দেশের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশে ৪০ শতাংশ গরু এ রোগে মারা গেছে বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে।দিনাজপুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলতাফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, যারা আক্রান্ত গরু আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন তাদের আমরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। পাশাপাশি আক্রান্ত গরু আলাদা ঘরে রেখে মশারি দিতে বলছি। তবে অনেকে গ্রামের চিকিৎসকের পরামর্শে এই রোগে আক্রান্ত গরুকে ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছেন। এতে আক্রান্ত পশু আরও দুর্বল হয়ে যায়। অনেকেই কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের অনেকের গরু মারা গিয়ে থাকতে পারে। তবে আমাদের কাছে সেই তথ্য নেই। আমরা তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি।