ছাত্র-জনতার ‘লংমার্চ টু ঢাকা’র মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গতকাল সোমবার দুপুরে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও তাঁর সঙ্গে দেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা জানান।
এর আগে গতকাল দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে সিএনএন-নিউজ১৮ জানায়, অন্য দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘সেফ প্যাসেজ’ দিচ্ছে ভারত সরকার। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পর তার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় বা কোন দেশে, তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। তিনি যুক্তরাজ্যে যেতে পারেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে।
সেই আগস্টেই দেশ ছাড়তে হলো হাসিনাকে
গণবিক্ষোভের জেরে শুধু প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগই নয়, বাংলাদেশও ছাড়তে হলো শেখ হাসিনাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিজের বাসভবনে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ কী বার্তা দেয়— এই প্রশ্নের বিশ্লেষণে বিবিসি বাংলা বলেছে, বাংলাদেশে কোটা সংস্কারকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তার একটি পরিণতি দেখা গেল শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে। সরকারকে শুরু থেকেই এই আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের অনেকটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা ছিল। এমনকি এক সপ্তাহের ব্যবধানে শত শত মৃত্যুর পরও পুরো বিষয়টিকে শুধু বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, এমনকি জঙ্গি হামলা হিসেবে বর্ণনা করে এসেছে সরকার।
তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার স্লোগান, দেয়ালে-দেয়ালে ‘স্বৈরাচার’ লেখা কোনো কিছুই যেন আওয়ামী লীগকে স্পর্শ করেনি।
যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সামান্য সমালোচনার জন্যও মানুষকে জেলে যেতে হয়েছে, হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় জ্বালাময়ী স্লোগান, সামাজিক মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের ঠাট্টা-বিদ্রুপ যে বার্তা দিয়েছে, সেটিতে তারা অবজ্ঞা করেছে।
বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই যেমন স্পষ্ট ছিল যে এই দাবি শেষ পর্যন্ত সরকারকে মেনে নিতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের এক দফা ঘোষণার পরও পরিষ্কার ছিল সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভ ও ঘৃণা নিয়ে কোনো সরকার টিকতে পারে না। এই রক্তপাত হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু সেই চেষ্টা আন্তরিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। সর্বময় ক্ষমতা এখানে শুধু নীতিভ্রষ্টই করেনি, বাস্তবতা থেকে অন্ধ করে দিয়েছে।
বিবিসির বিশ্লেষণে আরো বলা হয়েছে, ব্যাপক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, যেকোনো সমালোচককে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা—এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটি দেখতে না পারাটা শুধু দাম্ভিকতারই ইঙ্গিত দেয়। কোনো রাষ্ট্র প্রধানকে তখনই ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করতে হয়, যখন তাঁর সেই ক্ষমতা শুধু ক্ষমতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, এর পেছনে জনসমর্থন থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বে সেই বার্তাটাই দিলেন।(