রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর এবার কয়লা আমদানি সংকটের কারণে বন্ধ হতে চলেছে পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। বর্তমানে কেন্দ্রটিতে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ রয়েছে তাতে আর দুই সপ্তাহ চলবে। কয়লার বিল বাবদ ২৯৩ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। চলতি এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের এ বকেয়া পরিশোধ না করলে আর কয়লা সরবরাহ করবে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (বিসিপিসিএল) চিঠি দিয়েছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। এ চিঠির বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।
কয়লা সংকটের কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ২৫ মে এই উৎপাদন বন্ধ করা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর ৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এ ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
বিষয়টি জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়লা আমদানির বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আর কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। ২৯৩ মিলিয়ন ডলারের বকেয়া পড়েছে। এ অর্থ পরিশোধ করা না হলে সিএমসি আর অর্থ দেবে না অর্থ না পেলে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কয়লাও সরবরাহ করবে না। বর্তমানে প্লান্টে যে পরিমাণ কয়লা রয়েছে তা দিয়ে ১৫ দিন কেন্দ্রটি চালানো যাবে। এরপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা সিএমসির চিঠির বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।’
এদিকে, বর্তমানে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার মজুদ রয়েছে ১৫ দিনের।সেই হিসেবে মজুদকৃত কয়লা দিয়ে ১৫ মে পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানো যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে দৈনিক ১২ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন পড়ে। সেই হিসেবে প্রতি মাসে কেন্দ্রটির জ্বালানি বাবদ ৩ লাখ ৬০ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন। কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি করা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে।
কীভাবে তৈরি হল কয়লার সংকট?
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা কিনতে ঋণ দেয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চীনা অংশীদার চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব এই সংস্থা আর বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ বিনিয়োগে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালে।
আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ করে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। কেন্দ্রের পরিচালনার দায়িত্বও বিসিপিসিএলের ওপরই।
শুরু থেকেই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দায়িত্ব সিএমসির ওপর ছিল বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদুল আলম। তারা কয়লা কেনার জন্য অর্থ দিয়ে থাকে এবং প্রতি ছয় মাস পরপর কয়লার টাকা আদায় করে।
তিনি জানান, কয়লা আমদানির বকেয়া বিল না দিতে পারার কারণে নতুন করে কয়লা কেনা যাচ্ছে না।
খোরশেদুল আলম বলেন, ‘এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা) বকেয়া হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে তারা যে পেমেন্ট করেছে, সেটি শোধ করার কথা ছিল এই এপ্রিলে। এপ্রিলে আমরা এই টাকা দিতে পারিনি। এই বকেয়া বিল পরিশোধ না করা হলে সিএমসি আর কয়লা কেনার জন্য টাকা দেবে না। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লাও কেনা সম্ভব হবে না।’
আলম জানান, ডলার সংকটের কারণে কয়লার বকেয়া বিল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সপ্তাহ দুয়েক আগে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ডলারের কিছুটা সংকট থাকায় কয়লার টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
গত কয়েক মাসে তীব্র লোডশেডিংয়ের সময় দৈনিক এক হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি পরিমাণ উৎপাদন করে দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা রেখেছিল পায়রার আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তবে গত এক সপ্তাহ ধরে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমছিল। সর্বশেষ গত ২৭ মে এর একটি ইউনিট থেকে ২৫০ মেগাওয়াট থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদুল বলেন, “আগামী ৩ জুনের মধ্যে আমাদের দুটি উৎপাদন ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কালকে থেকেই এলসি ওপেন করা গেলে জুনের ২২/২৩ তারিখের দিকে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।”
‘তাদের মজুত কয়লা দিয়ে যতদিন সম্ভব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে বলা হয়েছে। তারপরও যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরবরাহ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হবে,’ তিনি যোগ করেন।